বিখ্যাতদের ভাবনা-একঃ শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য
সূর্যাস্তের পরবর্তী আকাশ (Courtesy:Jessie Eastland – <span class=”int-own-work”>নিজের কাজ</span> কর্তৃক “<a href=”http://commons.wikimedia.org/wiki/File:Split_Sky.jpg#mediaviewer/File:Split_Sky.jpg”>Split Sky</a>”। <a href=”//commons.wikimedia.org/wiki/”>উইকিমিডিয়া কমন্স</a> হয়ে <a href=”http://creativecommons.org/licenses/by-sa/3.0″ title=”Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0″>CC BY-SA 3.0</a>-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত।)
“আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ”/ “There sleep hills leaning on the sky”
উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রাস্তার এক বাড়ির ছয় তালার ছাদে যাওয়া এখন আমার রুটিন কর্ম। নাতিন লিয়ানাকে আকাশ দেখাতে নিয়ে যেতে হয়। চারিদিকে দূরে কাছে আরও উঁচু উঁচু ইমারত।ওরা যেন আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে পড়ে আমাদের জাতীয় কবির উপরের বিখ্যাত গানের চরণটি। যুবা বয়স থেকে পাহাড় দেখে দেখে ওই চরণটি গুন গুন করেছি।এখনো মনে গেঁথে আছে তা। ছাদে গেলে গানটি গাইতে ইচ্ছা করে। কেবল এ একটি লাইনই জানি। গানের মত উচ্চারন করি। লিয়ানা সাথে সাথে কিছু একটা উচ্চারণ করতে চায়।আকাশের উড়ন্ত চিল আর পাঁশের বাড়ির ছাদের কবুতরের উড়া উড়ি কখনো যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেদিকে সে তার ক্ষুদ্র আঙ্গুলি উঠিয়ে আমাকে যেন দেখাতে চায়। তার নিজ ভাষায় আমাকে সে যেন কিছু বলে। এক সময় তার দৃষ্টি ডান দিকে লাগোয়া পাঁশের বাড়ির ছাদে পত পত করে উড়তে থাকা বাংলাদেশের পতাকার দিকে যায়। ও সে দিকে তার হাত উঠায় আর অঙ্গুলি প্রসারিত করে।আমিও বলি, “ওই যে পতাকা” নানু! সে ও কিছু বলে। তা যেন ‘পতাকার’ মত শোনায়। মাথার উপর দিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে উড়ে যাওয়া কোন বিমানের শব্দে ওর দৃষ্টি মহাশূন্যের দিকে ধাবিত হয়।
মন তখন আমার পবনের নাওয়ে সওয়ার হয়ে অন্য কোথাও অন্য কোন কিছুর খোঁজে! বিমান বাহিনীর ফেলকন হলে যেন তা অবতরণ করে। সে দিন ছিল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ। রামপুরা এক্রামুন্নেসা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আলী আশরাফ স্যারের চিকিৎসক কন্যার আর এক চিকিৎসকের সাথে বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা। সে কলেজে আমি ২৫ বছর শিক্ষকতা সম্পন্ন করে অবসর নিয়েছি (মাধব্দি ডিগ্রি কলেজ ও অন্য কলেজসহ)। সেখানে আমার সহপাঠী ছিলেন এ টি এম হেমায়েত উদ্দিন। তিনি সে অনুষ্ঠানে মুনাজাত পরিচালনা করেন।তিনি নব দম্পতির সুখের জন্য, দশ, দেশ ও পৃথিবীর শান্তির জন্য আর মৃতদের পরকালিন মাগফেরাতের জন্য দোয়া করেন। তিনি আমাদের এক সময়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ আলিম আলী স্যারের ভীষণ ভক্ত ছিলেন।আমরা দুই জনই তাঁর খুব প্রিয় ছিলাম। স্যার এখন মৃতদের মাঝে একজন। আমার কলেজ জীবনেই আমরা আর একজন দক্ষ ও প্রিয় অধ্যক্ষ হারিয়েছিলাম। তিনি আবুল কালাম আজাদ।আল্লাহ্ তাঁদেরকে বেহেশত নসীব করুন। আমিন!
মন পাখি আবার ডানা মেলে। আমার অতীতের বিমান বাহিনী জীবনে ফিরে গিয়ে এক বেস থেকে আর এক বেসে উড্ডয়ন করতে থাকে। তখন আমি তরুণ বিমান সেনা। অতপর এ ই সির জীবন। অবসরের পর কলেজ জীবন। এখন মাঝে মাঝে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর) জাহিদ স্যারের সাথে মসজিদে দেখা হয়। এক সময় তিনি সেনা শিক্ষা কোরে কর্মরত ছিলেন। যথা সময়ে তিনি সে কোরের প্রধান তথা ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাঁর সেনা জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পূর্বে। কাছা কাছি তিনি কোথাও থাকেন।
মনে পরে হাইকার (Heritage International College of Aviation and Management) কথা।সেখানে আমি কিছু দিন উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছি। ছাত্রের অভাবে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আমি এখন যে সড়কে থাকি তা সে সড়কেই ছিল। এরপর কিছুদিন সেখানে অন্য স্কুলের নাম ফলক দেখলাম আর এখন অন্য একটির। আমি বুঝতে পারিনা যেখানে বহু নামকরা প্রতিষ্ঠানের অভাব নাই সেখানে উদ্যোক্তারা কেন নূতন প্রতিষ্ঠান খুলে মূলধন হারানোর ঝুঁকি নেন।বিশাল বৃক্ষের ছায়ায় নতুন চারা গাছের বেড়ে উঠার সুযোগ যে খুবই কম। বাংলাদেশে এমন জায়গারত অভাব নাই যেখানে মানুষ তাঁদের সন্তানদের জন্য ভাল প্রতিষ্ঠান চায়, সেসব স্থানে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোললে টিকে থাকার সম্ভাবনা শতভাগ ।উল্লেখ্য, উত্তরায় রয়েছে ছাত্র গিজগিজ করা রাজউক, উত্তরা মডেল, কেম্ব্রিয়ান আর গরিব মানুষের স্কুল ‘বাইলজুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ সহ কিছু এম পি ও ভুক্ত প্রতিষ্ঠান। নতুন আশা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল মাইল স্টোন স্কুল ও কলেজ। কর্নেল নুরুন নবী প্রতিষ্ঠিত এ কলেজকে আমার নিকট পরে আসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহের মাঝে সবচেয়ে সফল মনে হয়। এর কারণ মনে হয় কর্নেল স্যার সময়ে সময়ে ছিলেন ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ইত্যাদির পরিচালক। এ ই সি জীবনে তাঁর সুনামের অন্ত ছিলনা। আমরা একই যুগে এ ই সিতে কর্মরত ছিলাম। বলা যায়, ” We served the AEC together”.
আমার কাছে সব চেয়ে আশ্চর্য মনে হয় যখন দেখি কোন কিছু না বুঝে বা দেখে এবং বাস্তব শিক্ষা দানের কোন সুযোগ সৃষ্টি না করেই এ দেশে বিমান বিদ্যার মত জটিল বিষয় পাঠ দানের জন্য নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠায় কেও কেও এগিয়ে আসেন। পরে এ ধরণের বিষয় শিক্ষাদানের জটিলতা অনুভব করে তাঁদের সকল সাহস হারিয়ে ফেলেন! বন্ধ করে দেন সে প্রতিষ্ঠান! মাঝ থেকে হাওয়া হয়ে যায় হাতের পুঁজি! স্টাফ আর ছাত্র ও প্রশিক্ষকগন হতাশ হয়ে অন্য কোন উপায় অন্বেষণ করেন।
ক্যাটেকে সি আই হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি প্রায় দুই বছর। ক্যাটেক (College of Aviation Technology) সুমন স্যার আর মলি ম্যাডামের সুযোগ্য নেতৃত্বাধীনে এখনো একটি ভাল প্রতিষ্ঠান। ই ইয়া সা আর এডেক্সেলের বিবিধ কোর্স করে এখন এ কলেজের অনেকেই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। শুনে ভাল লাগে। দেখে ভাল লাগে কলেজ আঙ্গিনায় এক বিশাল আন্তনভ-২৬ রুশ নির্মিত বিমান দেখে। ওরা সেটি ছাত্রদের বাস্তব প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কিনে এনেছে। এ সি বির প্রধান প্রশাসক মুসলিম স্যার বহু পূর্ব থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্য সেস্ না বিমান বাস্তব প্রশিক্ষণে ব্যাবহার করছেন। আমার নাতিন তানিশাও বিমানটি বেশ কয়বার দেখে এসেছে। এটি নাকি তাঁর প্রিয় বিমান। একবার সে এর ককপিটে বসে শখ মেটাতে চায়। অবশ্য সে কয়েকবার বাবা-মায়ের সাথে ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ঢাকা ভ্রমণ করেছে। এ আই বির (Aeronautical Institute of Bangladesh) প্রধান আকমল স্যার সে দিন কথা প্রসঙ্গে জানালেন এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান কেবিন ক্রু কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের বড় বিমানে বাস্তব প্রশিক্ষণ দানে সক্ষম। এ আই বি এখন ডিপ্লোমা আর ডিগ্রি কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে। সি এ এ বি অনুমোদিত এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র কোর্স। কেবিন ক্রু কোর্সে আগ্রহিগন এ প্রতিষ্ঠানেও যোগাযোগ করে ভর্তি সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। অন্য প্রতিষ্ঠানেও খোঁজখবর নিতে পারেন। এন আই ই টি তেও (National Institute of Engineering and Technology) একজন সি আই হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। আলিম স্যারের ও তাঁর সজনদের সুযোগ্য পরিচালনায় এটি এখন একটি নামকরা পলি টেকনিক প্রতিষ্ঠান। তাঁরা অবশ্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সফলতার সাথে পরিচালনা করছেন। আমার মনে হয় কেবল নামকরা স্থানে নয় দেশের যে কোন স্থানে প্রতিষ্ঠান গড়ে তাঁরা সফল হতে পারেন। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যুব-যুবাদের আনন্দময় বিচরণ ক্ষেত্র। এসব এলোমেলো চিন্তা মনো রাজ্যে ঝড় তোলে।
লিয়ানার চঞ্চল আচরণ আমাকে বাস্তবে নিয়ে আসে। তার দৃষ্টি তখন হয়ত সামনের বড় সড়ক পেরিয়ে দেশের সবচেয়ে পুরানো এভিয়েশন শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান ‘এরোনটিকাল কলেজ অব বাংলাদেশের’ (Aeronautical College of Bangladesh /ACB) সামনে উড়তে থাকা পতাকাটির দিকে বা কলেজের দেওয়ালে ঝুলানো বড় একটি জেট বিমানের ছবির দিকে। তা অবশ্য নিশ্চিত নই আমি ! প্রায় দুপুরের আকাশে সূর্যের তপ্ত তেজ। লিয়ানার মুখে মা উচ্চারণ। লিফট বেয়ে ঘরে ফিরে আসি।
প্রায় এক বছর পূর্বে লিয়ানার জন্ম। তখন আমরা এ বাসায় সবে এসেছি। উত্তরার হিজড়া কালচারের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না।লিয়ানার জন্মের কথা জেনে হিজড়াদের হামলা হল। বড় অঙ্কের চাঁদা নিয়ে ওরা চলে গেল। যাক সে কথা। ছাদেই কিছু শিশুর সাথে জানাশুনা। পাঁশের ছাদ থেকে আরও দুই একজন শিশু উঁকি দেয়।হয়ত আমাকে দেখে বা আমাদের মারুফ, সাদিদ, আরিফ, রাইসা, তানিশা বা ছাদের অন্য শিশুদের দেখে, কে জানে! হয়ত তাদের সৌখিন মাদের কষ্টে বানানো ছাদ বাগানের গাঁদা, গোলাপ, জারবেরা, ডালিয়া, তুলসি, ক্যাকটাস, কালো মরিচ, গাছে ঝুলে থাকা লেবু, চমৎকার বামন কাঁটাযুক্ত ডালে কাঁটার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরার মত ফুটে থাকা রঙিন ফুলের আভা বা টবের পাম অথবা কন্দল চারাগাছের বা খ্রিস্টমাস ট্রি নামের ঝাউ গাছের শিল্পিত সবুজ ডাল-পালা, পাতা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে! শিশুর মন কেবল শিশুরাই জানে!
জন্ম, যুবা বয়স, বিবাহ,বৃদ্ধ বয়স,মৃত্যু এসব নিয়ে এ বাংলা-ভারতের কবি লেখকদের ভাবনার অন্ত ছিল না। প্রাচীন কালের হিন্দু মুনিঋষি, বুদ্ধদেব সবাই এ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাদের মতামত স্মৃতি, স্রুতি আর ত্রিপিটকে দেখা যায়।এ ভারতে ইসলাম এসেছে যথা সময়ে। এ সব নিয়ে ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ সমূহে মতামতের অন্ত নাই।সুতরাং, এ উপমহাদেশের সকল ধর্ম সমূহের সকল ভক্ত মাত্রই তা কমবেশি অবগত। সে কথা ধর্ম গুরুদের নিকট থেকে জেনে নিবেন।এখানে অবিভক্ত বাংলার দুই জন বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের কিছু মতামত যথা স্থানে তুলে দিলাম।
বাজার, মসজিদের পথে পার্কে, মাঠে বয়স্ক শিশু কিশোরদের সাথে দেখা হয়। ওরা এ যুগের সন্তান।উত্তরার যেখানে থাকি চারি দিকেই এখন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। সকাল থেকেই চোখে পড়ে নানান বয়সের ছাত্রছাত্রী। ওদের কল কাকলিতে মুখর শিক্ষালয়ের আঙিনা। কেমন ছিল ব্রিটিশ ভারতের শিশু কিশোরদের শিক্ষা।জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিলাসী নামের এক গল্পে বলেনঃ
“পাকা দুই ক্রোশ পথ হাঁটিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই—দশ-বারোজন। যাহাদেরই বাটী পল্লীগ্রামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশি জনকে এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয়”।
“তার পরে এই কৃতবিদ্য শিশুর দল বড় হইয়া একদিন গ্রামেই বসুন, আর ক্ষুধার জ্বালায় অন্যত্রই যান—তাঁদের চার-ক্রোশ হাঁটা বিদ্যার তেজ আত্মপ্রকাশ করিবেই করিবে”।
“তার পরে একদিন ছেলেপুলের পড়াও শেষ হয় বটে, তখন কিন্তু শহরের সুখ-সুবিধা রুচি লইয়া আর তাঁদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না”।
“কিন্তু থাক এ-সকল বাজে কথা। ইস্কুলে যাই—দু’ক্রোশের মধ্যে এমন আরও ত দু’তিনখানা গ্রাম পার হইতে হয়। কার বাগানে আম পাকিতে শুরু করিয়াছে, কোন্ বনে বঁইচি ফল অপর্যাপ্ত ফলিয়াছে, কার গাছে কাঁঠাল এই পাকিল বলিয়া, কার মর্তমান রম্ভার কাঁদি কাটিয়া লইবার অপেক্ষা মাত্র, কার কানাচে ঝোপের মধ্যে আনারসের গায়ে রঙ ধরিয়াছে, কার পুকুর-পাড়ের খেজুর-মেতি কাটিয়া খাইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা অল্প, এইসব খবর লইতেই সময় যায়, কিন্তু আসল যা বিদ্যা—কামস্কট্কার রাজধানীর নাম কি, এবং সাইবিরিয়ার খনির মধ্যে রূপা মেলে, না সোনা মেলে—এ-সকল দরকারী তথ্য অবগত হইবার ফুরসতই মেলে না”।
এখানে আমাদের কালের শৈশবের কথা একটু না বলে পারলাম না। নানা সামসুল ওয়াহেদ মুন্সী সে সময় তেজগাঁ ষ্টেশনের রেল লাইনের ধারে বি কে আফতাব স্কুলের শিক্ষক। তাঁর হাত ধরে আমার স্কুল যাত্রা শুরু। তা বাড়ি থেকে দুই ক্রোশের কম ছিল না। পরে যখন রায়ের বাজার স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হই সেটির দূরত্বও ছিল একই সমান। এর পরে অবশ্য বাবা আমাকে বাড়ি থেকে এক ক্রোশ দূরের সরকারি ফার্মের প্রাথমিক স্কুলে ২য় শ্রেণীতে ভর্তি করে দিয়েছেলেন। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র তাঁর যুগে লেখা পড়ার যে হাল বয়ান করেছিলেন আমাদের যুগে এর থেকে আলাদা তেমন কিছু হয়েছিল তা হলফ করে বলতে পারব না। পাড়া গায়ে মনে হয় তেমনি ছিল। আজও বাংলাদেশ আর ভারতের অজ পাড়া গাঁয়ে এমন অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে বলে মনে হয় না। শহরের কথা অবশ্য আলাদা। এর আনাচে কানাচে এখন শিক্ষালয়। আমাদের হাই স্কুল যুগেও ঢাকা শহরে ছিল স্কুলের আকাল। দূরের বাড্ডা, বনানী থেকেও আমাদের তেজগাঁ পলি টেকনিক হাই স্কুলে ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসত।নোয়াখালী থেকে এসেছিল মইন আর মাহমুদের বাড়ি কোথায় ছিল জানিনা। ওরা একসময় পি এ এফ পাবলিক স্কুল সারগোদাতে পড়ার জন্য সে কালের পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। আমার সাথে অবশ্য সারগোদাতে মাহমুদের সাথে দেখা হয়েছে। মইন নাকি তখন বিমান বাহিনীতে নয় সেনা বাহিনীতে কমিশন পেয়ে পি এম এতে শক্ত সামরিক প্রশিক্ষণরত। তাঁর সাথে স্কুল জীবনের পর আর কখনো দেখা হয় নাই। শুনেছিলাম তাঁর মেজর হওয়ার কথা। সে নাকি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে । সামরিক জীবনে ও পরে মাহমুদকে অনেক খুঁজেছি। হদিস মেলেনি।
স্কুলের কথায় ফিরে আসি। মজার কথা হল আমার বাবা, আমি ও আমার মেয়ে নিজ নিজ যুগে এ একই স্কুলে বিদ্যা লাভ করেছি। লিয়ানার নানু অর্থাৎ আমার সহধর্মিণীও সে একই স্কুলের ছাত্রী। তা বলে এ কথা মনে করার কোন কারণ নাই যে আমাদের সাথে সে সময় জানা শোনা ছিল।
বাবার কাছে শুনেছি তাঁর শিক্ষক দীনেশ স্যার আর মাখন স্যারের কথা। তাঁর যুগে তাঁরা ছিলেন দক্ষ তরুণ শিক্ষক। আমার সময় তাঁরা শেষ বিকেল অতিক্রম করছেন। তাঁদের বেত্রাঘাত আমার সহ্য করতে হয় নাই। তবে সালাম স্যার আর জুলহাস স্যার তখন মধ্য গগনে। তাঁদের পিটুনি আমি খেয়েছি। এখন তাঁরা সকলেই অন্য জগতের মানুষ।পরলোকে মহান স্রষ্টার কৃপা সকলের উপর বর্ষিত হউক। আমার কন্যার ছাত্রী জীবনে সম্ভবত জুলহাস স্যার অন্য কোন সরকারি স্কুলে।সালাম স্যার শিক্ষকতা ত্যাগ করে উকিল হন। যাক তাঁদের সকলকেই নিজ নিজ সময়ে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে যেতে হয়েছে।