সেনা কথন-১ :Once we served together

images of death এর চিত্র ফলাফলCourtesy:Internet

২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর। আমিন স্যারের কথা মনে পড়ল। ১৯৭৬ সালে তিনি সেনা শিক্ষা কোরের একজন সুবেদার। আমাদের বেসিক কোর্সের ‘মানচিত্র পঠন’ বিষয়ের একজন প্রশিক্ষক। সে সময় সেনাসদর সেনা শিক্ষা কোরের নয়া জেসিওদের শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা সেনা নিবাসের রমিজ উদ্দিন হাই স্কুলটিকে বেছে নিয়েছিল। সেখানেই আমাদের বিষয় ভিত্তিক ক্লাস সমূহ হত। সেখানেই তিনি তাঁর রুটিন মাফিক আমাদের পড়াতে আসতেন। মানচিত্রের বাস্তব প্রশিক্ষন দানের জন্য আমাদের আউট ডোরে নিয়ে যেতেন। অবসর কালে তিনি ছিলেন অনারারি ক্যাপ্টেন। তিনি ছাড়া একই কোর্সে অন্য একজন সুবেদার আমিন ছিলেন। তিনি আমাদের একই বিষয় পাঠ দান করতেন। বহু দিন পূর্বে তিনি গত হয়েছেন।

যাক আমিন স্যারকে সে দিন ফোন দিয়েছিলাম। মনে হল ফোনটি অকেজো। আমার চাকরি জীবনের অন্য একজন কাছের মানুষ অনারারি ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন সাহেবকে ফোন দিলাম। ১৯৮৬ সালে আমরা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে দুইটি আলাদা সেনা ইউনিটের এডুকেশন জেসিও ছিলাম। তাঁকে আমিন স্যারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। কষ্টের সাথে তিনি জানালেন, “একমাস পূর্বে তিনি এ জগত ছেড়ে চলে গেছেন।”

দৈনিক প্রথম আলোর মাধ্যমে জানতে পারলাম ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর কর্নেল অনন্ত কর দেহ ত্যাগ করেছেন। তিনিও ছিলেন আমার প্রশিক্ষক। উল্লিখিত একই কোর্সে তিনি আমাদের শিক্ষা মনোবিজ্ঞান পড়াতেন। তখন তিনি ছিলেন সেনা শিক্ষা কোরের একজন ক্যাপ্টেন। পরে আমরা একসাথে  আর্মি স্কুল অব এডুকেশন এন্ড এডমিনিস্ট্রেশনে চাকরি করেছি। স্কুলটি যখন ঘাঁটাইল সেনানিবাসে তখন তিনি কর্নেল। একসময় তিনি সে স্কুলের কমান্ডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তখন একবার আমি তাঁর সাথে দেখা  করে আমার একটি পুস্তক স্কুল লাইব্রেরীর জন্য দিয়ে এসেছিলাম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি শান্ত মরিয়ম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। কাছে থাকার কারণে বেশ কয়েকবার আমি তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছি। একদিন তিনি তাঁর অসুস্থতার কথা জানালেন।  চাকরি করতে আসা কষ্টের বিষয়ও উল্লেখ করলেন। তবে জানালেন বাড়িতে বসে কেবল মরণ চিন্তার বদলে বিবিধ ব্যাস্ততায় এখানে সময়টা ভালই কাটানো যায়।

কর্নেল এজাজ আর্মি স্কুল অব এডুকেশন এন্ড এডমিনিস্ট্রেশনে একজন কমান্ডেন্ট ছিলেন। তাঁর একজন ভাইও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি অবসর প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওয়াজিউদ্দিন। পত্রিকায় তাঁর ডি ও এইছ এস এর নিজ বাড়িতে রহস্যজনক ভাবে নিহত হওয়ার কথা জানলাম।১৯৮১-৮২ সালে আমাকে বহুবার  ‘Aircraft recognition course’ এর ছাত্রদের নিয়ে ‘ Army Aviation’ এ যেতে হয়েছিল। সে ইউনিটের তৎকালীন সি ও ছিলেন লেঃ কর্নেল ওয়াজি উল্লাহ। তিনি নিজেই ছাত্রদের বিমান বিদ্যা শিক্ষা দানে আগ্রহী ছিলেন।সে সময়ের অন্যদের মাঝে সুবেদার মেজর শরীফ সাহেবের কথা মনে পড়ে। তিনি প্রেছিস দিয়ে বা অন্য ভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন। সে সেনা ইউনিটে ৫ লাইট এক এক রেজিমেন্টের কিছু সেনা ই আর ই ডিউটিতে ছিলেন আর বৈমানিকদের কেউ কেউ সেখানে সংযুক্ত থাকতেন। এমন একজন বৈমানিক ছিলেন কোর্সটির উপদেষ্টা।  আমি তখন সে ইউনিটের এডুকেশন জেসিও। আমার পি এ এফ এবং বি এ এফে বিমান প্রকৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষন থাকার কারণে টু আই সি সাহেবের চেষ্টায় কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপর বর্তায়। সেখানে যাদের সাথে কাজ করেছি জানিনা এখন তাঁরা কোথায় আছেন। তবে শুনেছিলাম সুবেদার মুহাম্মদ আলী সাহেব অবসর নিয়ে টাঙ্গাইলে বাড়ি ফেরার পর পরই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আমার সময় তিনি ছিলেন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির জে সি ও ইন চার্জ। এ রেজিমেন্টের অন্য একজন সেনার মৃত্যু কেউ ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি ছিলেন একজন নায়েক। দূই মাসের ছুটিতে তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন। ছুটি শেষে স্টাফ রোডের রেল ক্রসিংএর কাছে রেল লাইনের পাশে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। জানিনা কেমন করে ছুটন্ত ট্রেন তাঁকে আঘাত করে। অপর কষ্টকর মৃত্যুটি ৩৩ বেঙ্গলের এক সৈনিকের। গ্রাজুয়েট এ সৈনিকটি ছিল একজন সেনা শিক্ষক। কোন একরাতে কর্তব্য পালন কালে কেন জানি নিজেই নিজ রাইফেল থেকে নিজেকে গুলি করে মরণকে বেছে নেয়। উল্লেখ্য, আমি এ ইউনিটে ১৯৭৭-৭৮ সালে কর্মরত ছিলাম।

আমার সেনা জীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিমান বাহিনীতে। আমার সামরিক প্রশিক্ষণের শুরু হয়েছিল আর টি এস, পি এ এফ কোহাটে। একদিন শুনলাম একজন বাঙালি এডুকেশন ইনস্ট্রাক্টর মুনির স্কোয়াড্রনের পিছনের বিশাল সফেদা (শিশু) গাছের উঁচু ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন।জানিনা কি জানি কোন দুঃখে তিনি নিজেই দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কে জানে! যাক,  প্যারেড গ্রাউণ্ডে আমরা তাঁর জানাজায় অংশ নিলাম। পরে সামরিক নিয়মে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হল। এমন ফুনারেল প্যারেডে কমান্ডেন্টসহ সকল সেনাদের উপস্থিত থাকার নিয়ম। দিতে হয় গান স্যালুট আর বিউগলে বাজাতে হয় সুনির্দিষ্ট করুন সুর।

RTS, PAF, Kohat আর SOA, PAF, Korangi Creek এ প্রশিক্ষন শেষে বিমান বাহিনীর সক্রিয় ইউনিটে বদলি হলাম। এল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সত্বর আমাদের বন্দি শিবিরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হল। রেড ক্রস আর রেড ক্রিসেন্টের খাতায় আমাদের নতুন পরিচয় হল POW (Prisoners of War) বা যুদ্ধ বন্দি। বান্নুর বন্দি শিবিরে একজন সার্জেন্ট সাহেবের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। তিনি ছিলেন একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেডের সিনিয়র এন সি ও।অবশ্য, একজন ডাক্তার সাহেব মাঝে মাঝে আমাদের চিকিৎসা দিতেন ও চলে যেতেন। সুতরাং,  তিনিই ছিলেন আমাদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসক। বাঙালি ছিলেন বিধায় তিনিও আমাদের মত বন্দি ছিলেন এবং বান্নুর দুই নম্বর ক্যাম্পেই থাকতেন।সেখানে বন্দিদের স্বাস্থ্য সচেতন করার দায়িত্ব তাঁর উপরেই ছিল।মনে পড়ে একদিন তিনি ভি ডি (সামাজিক ব্যাধি)  সহ অন্য রোগ থেকে বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে কথা বলছিলেন। দেখে তাঁকে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান মনে হত। যাক, তিনিই একদিন স্বাভাবিকভাবে মরে গেলেন। সম্ভবত তাঁকে ক্যাম্পটির পাশে কাবুল নদীর বেলাভূমিতে বানানো গোরস্থানটিতে কবর দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের সর্বশেষ বন্দি শিবির ছিল PAF Camp, Chasma, Mianwali. মনে পড়ে সেখানে বাঙালি বন্দিদের ফ্যামিলি কোয়ার্টরে কারো মৃত্যু হয়েছিল। মনে নাই তিনি বিমান সেনা ছিলেন না বন্দি পরিবারের কোন সদস্য ছিলেন।তবে কারো জানাজায় সম্ভবত আমিও যোগ দিয়েছিলাম।

১৯৬৯ থেকে আমার সেনা জীবন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বিমান ও সেনা বাহিনীর অনেক ইউনিটে আমার চাকরি করার সুযোগ হয়েছিল। অতপর  একে একে আরও বহুকাল মহাকালে মিশে গেছে। বেসামরিক জীবনে আমার কলেজ স্তরের শিক্ষকতার ২৫ বছরের ২৪ বছরই কাটিয়েছি রামপুরা এক্রামুন্নেসা ডিগ্রি কলেজে। সে সময়ের মাঝে একজন শিক্ষক হাফিজ স্যার আর দুই জন অধ্যক্ষ আলীম আলী স্যার ও আবুল কালাম আজাদ স্যারকে হারিয়েছি। আগেই হাফিজ স্যারের পেটে কাটা ছেড়া করতে হয়েছিল। অতপর তিনি চলে গেলেন আমাদের সাথে অনেক দিন থেকে। আলীম আলী স্যার ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্ম কর্তা। সেই পাকিস্তানী আমলে তাঁর ইউ টি সি তে (বর্তমান বি এন সি সি) পোস্টিং হয়েছিল। সেখানে তিনি তাঁর সমমর্যাদার ক্যাপ্টেন এর সামরিক পোশাক পরিধান করতেন। অতপর তাঁর মূল কর্ম শিক্ষকতায় ফিরে যান। সরকারি চাকরি থেকে অধ্যক্ষ পদে অবসর নেন এবং পরে আমাদের কলেজের দায়িত্ব নেন। মৃত্যুর আগে তিনি হাসপাতালে কোমা অবস্থায় ছিলেন। আর আবুল কালাম আজাদ স্যার কর্মরত অবস্থায় কলেজেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুকে বরন করে নেন।

মনে পরে এডভোকেট সুজাত আলী চাচার কথা। তিনি ছিলেন গ্রিন সুপার মার্কেটের এম ডি। তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী মানুষ। তিনি মার্কেটটিতে ‘শিক্ষা প্রচার মিশন’ বানিয়েছিলেন। এ এন জি ও টি পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করত। জনাব নওয়াব আলী স্যারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তিনি তাঁর প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতেন। আমিও সেখানে স্বেচ্ছা সেবক হয়ে কাজ করেছি। ফার্ম গেট ও কাওরান বাজার শাখায় পথ শিশুদের অক্ষর জ্ঞান দিয়েছি। একদিন তিনি এ জগত ছেড়ে চলে গেলেন। এখন গ্রিন সুপার মার্কেটে তাঁর বানানো মিশনটি আর নাই। পরবর্তী প্রশাসকগণ মার্কেটে পথ শিশুদের জন্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া ফজুল মনে করেছেন।

যাক, এবার আমার সামরিক জীবনের সাথীদের কথা বলি। এখন তাঁদের অনেকেই পর জগতে। অন্যরাও চলে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন। যে যেখানে আছেন সকলের মঙ্গল কামনায়। সুখি হোক সকল সত্তা।

 

 

About Syed Mohd. Saleh Uddin

I am from Bangladesh (East Pakistan before 1971). I joined the PAF in 13 February, 1969 then served in the BAF and Bangladesh Army (AEC) and retired (as SWO) from the Bangladesh Army in December, 1986. Then I joined in a college as a Lecturer and lastly retired from the Rampura Ekramunnessa Degree College situated in Dhaka, Bangladesh in July 2012 as an Assistant Professor. During this long period, time to time I worked in the Dhaka University, National University, Bangladesh Open University, BISE and BTEB as an examiner or scrutinizer etc. I also served in the CATECH, HICAM, NIET etc institutes in different teaching capacities and now working in a literary project of Dr. Shah A. Rahim (Associate professor, BOU) as a translator of literary works and a free lancer for the world media viewers. I have few publications of various interests in Bangladesh.
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

Leave a comment